সুমন গুণ

বাংলায় ছোটদের জন্য লেখার সমারোহময় ঐতিহ্য আছে। বিষয়ের সৌরভে, ছন্দমিলের ধুন্ধুমার লাবণ্যে বহু লেখাই আমাদের কাবু করেছে, বশ করে রেখেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম। অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর ‘হীরু ডাকাত’ এইরকমই একটি লেখা।

গোটা লেখাটির মধ্যে যে সচ্ছলতা, যে অনায়াস উৎসাহের অর্চনা, তার সবচেয়ে বড় ভর ভাষায়। শব্দের বহুমাত্রিক সখ্যে, গোপন ও প্রকাশ্য স্বরের অনবরত ওঠা পড়ায়, মিলের সূক্ষ্মতম দাক্ষিণ্যে কত কাণ্ডই যে ঘটেছে এখানে। অবশ্যই তাতে সায় দিয়েছে পাতায় পাতায় দেবব্রত ঘোষের দুর্বার সব ছবি। লেখাটির মধ্যে কোন অযথা অতিশয়োক্তি নেই, অথচ কল্পনার বর্ণময় উল্লাসে প্রতিটি চরিত্র ডানা মেলে দিয়েছে। নতুন নতুন পরিবেশের ঢেউ উঠেছে গল্পে, উক্তি প্রত্যুক্তির মারাত্মক ইন্ধনে উত্তেজনা উসকে উঠেছে। আমি আপাতত শুধু নজর দেব লেখাটির মধ্যে মিলের মধুর ও অর্থময় নানা কাণ্ডকারখানায়। কী বর্ণনায়, কী কথোপকথনে, আগাগোড়া গল্পটা যেহেতু পদ্যে বলা হয়েছে, তাই মিলের দায়িত্ব বেড়ে গেছে অনেকটাই। পদে পদে ঝোঁক বদলেছে মিলের; কখনও ঘন ঘন, কখনও একটু বিরতি নিয়ে চাল সামলাতে হয়েছে। আর এর ফলে নাটকীয়তার দুরন্ত আন্দোলন তৈরি হয়েছে গোটা রচনা জুড়ে। ভাষাই রচনাটির একটা বড় অংশের নির্মাণে সাহায্য করেছে। ভাষার সরণি ধরে চোখ কান খোলা রেখে চলতে চলতেই আমরা তার হদিশ পাব। এই যাত্রায় আমাদের মনে পড়তেই পারে বাংলায় ছোটদের জন্য লেখার আর একজন শীর্ষ কুশীলব সুকুমার রায়ের ‘ভাষার অত্যাচার' প্রবন্ধটি। ভাষা ব্যবহারে আমাদের অন্ধ অভ্যাসের মধ্যেই যে রয়েছে একই সঙ্গে মূঢ়তা আর প্রভুত্বের ইঙ্গিত, এই প্রবন্ধে সুকুমার রায় তা বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়েছেন। লিখেছিলেন তিনি: 'যে কারণে মানুষ শাস্ত্র ব্যবস্থার উদ্দেশ্যকে ছাড়িয়া তাহার অনুশাসন লইয়াই সন্তুষ্ট থাকে, ঠিক সেই কারণেই মানুষের চিন্তা আপনার উদ্দিষ্ট সার্থকতাকে ছাড়িয়া কতগুলি শব্দের আশ্রয় নিশ্চিন্ত থাকিতে চায়।' এই নিশ্চিত্তি ভেঙে দিয়েছেন হীরু ডাকাত-এর লেখক।

আরও একটা কথা আছে। অমরেন্দ্র চক্রবর্তী মূলত কবি। তাই মিল তাঁর কাছে শুধু প্রয়োজনের বিন্যাস হয়েই থাকেনি, অনেক সময়ই অর্থাত্তরের ইশারা দিয়েছে। আমাদের কবিতা পড়ার মন তাই মাঝে মাঝে চলকে উঠেছে বইটি পড়তে পড়তে। তবে কবিতায় দেখা না-দেখায় মেশা রহস্যময় অস্পষ্টতা ডানা মেলতে পারে, মাটিতে তাকে না নামালেও চলে। তার ভর মূলত শব্দের নিজস্ব ও স্বাধীন বিশৃঙ্খলায়। কিন্তু ‘হীরু ডাকাত’ আখ্যানের আদলে লেখা, কথোপকথনের সূত্রে সেই কাহিনি গতি পেয়েছে। এখানে সেই কাহিনির মধ্যে বিপর্যয় তৈরি করে, বিভিন্ন চরিত্রের কথা ও ভঙ্গিমার বৈচিত্র্যই ঘটিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছতে চেয়েছেন লেখক। তাঁর ধ্রুপদী মৌলিকতার অনেকগুলো ভর আছে। স্তর আছে। পর্যটন আছে। কখনও ভাষার ধ্বনিমুখর সরণি ধরে এগোতে হয় আমাদের, ধ্বনির নিজস্ব সামর্থ্যে গোটা স্থাপত্যটি আলোকিত হয়ে ওঠে। এরও দাম আছে এবং সেই দামটি খুব কম নয়। বুদ্ধদেব বসু একটি প্রবন্ধে এই মূল্যের স্বরূপ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন: 'ভাষাই উৎস... চিন্তা থেকে ভাষা নির্গত হয় না, ভাষাই চিন্তাকে জন্ম দেয়।'

অনেকগুলো খুরের শব্দ ভয়েই ওরা কাঠ!
ঠিক মনে হয় সামনের ওই বিরাট ঝাপসা মাঠ
টগবগ টগ টগবগ টগ বাজাচ্ছে ডুগডুগি
সূর্যও ঠিক ডুবুডুবু। খেলবার হুজুগই
কাল হল আজ।
খুরের আওয়াজ
আরো কাছে এসে পড়ল বলে।
টুপ করে ওই সূর্য পড়ল ঢলে।

কত অব্যর্থ অথচ অনায়াস বর্ণনা। ঝাপসা মাঠ যেন ঘোড়ার খুরের শব্দ বাজাচ্ছে- ছবি এখানে কল্পনার নিঃশব্দ ডানা পেল। সূর্যের পলাতক মুহূর্তটি আরও চোখে পড়ল খুরের আওয়াজ হামলে পড়ায়, এবং এটা যে ‘বলে’ আর ‘ঢলে'-র সচ্ছল মিলের সম্প্রসারণ হয়েই ঘটল সেটা আমরা অগোচরেই বুঝে ফেলি।
‘ডুগডুগি' আর 'হুজুগই’-র মত নিরহংকার মিল এই লেখায় অহরহ। যেমন:

‘সামনে ডাকাত, মাথার ওপরে প্যাঁচা।
ছেলে তিনটি দু-হাত তুলে চেঁচায়।'

"ভেড়া তোরা, যা না কামাখ্যা।
এই নে আখ খা!'

‘সর্দার কী একটা বুনো লতা
ঘষে নিয়ে রাখালছেলের ক্ষতে লাগাল তা।

“কী জানি বাবু, শুনি তো ওদের শীতগ্রীষ্ম নেই।
ওসব গুজব। তাছাড়া ওর অত শিষ্য নেই।'

'পথে পড়বে বুড়ো শিবের মন্দির,
সেখান দিয়েই নিয়ে যাবে করে তোদের বন্দী।'

‘সর্দার, চাঁদের হাট তো এসেই গেল, এই তো এটা কাকদ্বীপ!
এবার তবে বজরাটাকে সবাই মিলে হাঁক দিই?”

উহ্যবর্ণের এই যে অনুক্ত সমারোহ, কবিতার সরণি দিয়েই তো তার যাত্রা। ছড়া থেকে কবিতায় এই উদার অথচ অনুচ্চারিত যাতায়াতের অনেক উদাহরণ আমরা বিশ্বসাহিত্যে পাই। এই দুটি প্রকরণের মধ্যে অব্যবহিত সীমানা আছে। চারপাশে গোধূলিকালীন অন্ধকারে একটি সুদূরপ্রসারী সমুদ্র, যার ঢেউ পার ছুঁয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে অনন্তের দিকে। এই স্পর্শে ধ্বনি আছে, তৎপরতা নেই। উচ্চারণ আছে, তাড়া নেই। একটি অসমাপ্ত সেতু সব যাত্রা ও সম্ভাবনার স্মারক হয়ে দিগন্তের দিকে স্তব্ধ হয়ে আছে। এই স্তব্ধতার অনুবাদ হীরু ডাকাত-এর পাতায় পাতায়।

‘গাছে গাছে অট্টহাস্য করে উঠল বোধহয় বাতাসই।
সর্দারের ঠোঁটে ওঠে বাঁশি।

এখানে, বাঁশির আসন্ন মূর্ছনা যেহেতু ধারণ করবে বাতাসই, মিলটি তাই বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
ঠিক এইরকম:

অশথগাছের পাতায় বসল চাঁদ।
সর্দার: কাঁদ তোরা, যত পারিস কাঁদ!

এখানেও, জ্যোৎস্নায় যে কান্নার আমন্ত্রণ, তাকে স্পর্শ করল মিল।

'আমাদের এই গ্রামের নামটি চাঁদের হাট।
চাঁদের হাটের হীরু ডাকাত ভয়ঙ্কর,
দিনের বেলা বাঁশি বাজান, বয়েস ষাট,
রাতের বেলা মন্দলোকের আতঙ্ক।'

আতঙ্কের ভয়ংকর উৎস মিলের সূত্রে এভাবে ধরিয়ে দেবার জন্য লেখককে আমাদের সহর্ষ কুর্নিশ। এইরকমই:

‘ব্যস্ত হয়ে লাভ কী, বরং শুভস্য শীঘ্রম
ডান হাতের কাজ হোক গরমাগ্রম!'

এমন তড়িৎ মিল যে সম্ভব, এটা আগে কি আমরা ভেবেছিলাম ?
আবার, মিল দিয়ে বিষয়ের অসাম্য উসকে দেওয়ার কাজও করেছেন লেখক। যেমন:

‘দেখছেন না সোনার বোতাম, কানে দামী আতর?
বরের বাবার পায়ের কাছে কনের বাবা পাথর।

বিত্তবান বরের বাবার সুগন্ধি প্রতাপের বিপরীতে কনের বাবার অসহায় বিপন্নতার সমার্থক এখানে মিল।

‘পুব আকাশের ঠোটে
গোলাপী রং লাগে।
প্রথম জাগে যেসব পাখি, সেসব পাখি জাগে।'

আমাদের পুলক হয় এই বিস্ময়ে যে ‘লাগে’-র সঙ্গে ‘জাগে’ যে পুনরুক্ত তা আমরা টেরই পাই না। বরং শেষ লাইনে এই পুনরুক্তি কথার মধ্যে আত্মীয়তার জাগরণ ঘটিয়েছে।
এই ছবিটির মধ্যে যে-অতিরিক্ত অর্ধময়তা আছে সেটাই হীরু ডাকাত-এর লেখককে সাধারণ ছড়াকারের থেকে সবদিক থেকে আলাদা করে রাখে। প্রত্যেকটি শব্দ যেন একটি গোটা ছবির একেকটি টান। খেয়াল করে দেখুন, প্রতিটি শব্দই কিন্তু কোনও-না-কোনও ভাবে একটি করে দৃশ্যের জন্ম দিচ্ছে। একটি করুণ অথচ জটিল, আচ্ছন্ন কিন্তু প্রত্যক্ষ সম্ভাবনা আমরা টের পাচ্ছি বলেই এই সময়ের কবিতা পড়ার মন নিয়েই পড়তে পারছি আমরা কথাটি।
রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা আমি নানা লেখায় ব্যবহার করার লোভ সামলাতে পারিনি:

তব অঙ্গে অত্যুক্তি কি করনা বহন
সন্ধ্যায় যখন
দেখা দিতে আসো
তখন যে হাসি হাসো
সে তো নহে মিতব্যয়ী প্রত্যহের মতো
অতিরিক্ত মধু কিছু তার মধ্যে থাকে তো সংহত।

কথা হচ্ছে, এই যে অতিরিক্ত মধু, যা রচনার অনির্বচনীয়তাকে রক্ষা করে, তা কি সব বয়সের পাঠকের কাছেই সমানভাবে গ্রাহ্য হতে পারে? তা হয়তো নয়। চ্যাপলিনের ছবির ভাঁজে ভাঁজে যে বিভিন্ন বুনন, তার সবকিছুই কি শিশু-কিশোরের মন নিয়ে সবসময় ছোঁয়া যায়? একটি কাজ নানারকম স্তর নিয়ে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে, এই হয়ে-ওঠাটাই তার লক্ষ্য, এই লক্ষ্যের কতটা কাছে অথবা দূরে রইল লেখাটি, তা-ই তার সামর্থ্য চিহ্নিত করে দেয়।
এইরকম অজস্র স্বয়ম্ভর ছবিতে ভর্তি অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর কবিতা।

দারোগার সঙ্গে পুরোহিতবেশী হীরুর কথাবার্তায় সচেতন ধ্বনিবিপর্যয় ঘটিয়ে কাণ্ডই করেছেন লেখক:

‘হুজুর, আমি শিখিনি লেখাপড়া,
বিদ্যে বলতে সমোস্কৃত ছড়া—

বিপর্যস্ত শব্দটির তির্যক মজায় আমরা সহর্ষে বিদ্ধ হই। কাছাকাছি আরও একটি প্রয়োগ:

‘আমি আছি, ভয় কী বাবা, শোও গিয়ে সব শিগ্রি
এই ঘরে আজ চালাব থার্ড ডিগ্রি।

ঘরের কথার সব শক্তি ও সম্ভাবনা পরতে পরতে কাজে লাগিয়েছেন লেখক। তাঁর সামর্থ্য এখানেই যে তিনি এই দুস্তর কাজটি এমনভাবে সম্পন্ন করেছেন যে পাঠকের কাছে এর নেপথ্য পরম্পরাটি উহ্য থেকে যায়। এটা তিনি পেরেছেন কবিতার ভাষাশিল্পের ওপর তাঁর স্বাভাবিক দখল ছিল বলেই। মিল-অনুপ্রাস নিয়ে অভাবনীয় সব নিরীক্ষা করেছেন তিনি, শব্দকে দিয়ে সবরকম কাজ করিয়ে নিয়েছেন। কতরকমের মিল আমরা পড়েছি তাঁর লেখায়, একটু মনে করা যাক:

‘এমনি করে দিন কেটে যায় তাদের
গয়লাদের ছেলেরা খিদেয় কাঁদে।
তফাৎ নেই আর অমাবস্যায় চাঁদে
বুক ফেটে যায় গয়লাপাড়ার মাদের।'

এখানে, আমরা খেয়াল করি, গোয়ালপাড়ার মানুষজনের অপরিবর্তিত দুরবস্থা স্পর্শ করা হল চার লাইন জুড়ে একইরকম মিল স্থানু করে রেখে। তাঁদের এই নিরন্ন অসহায়তা আরও একবার ঝলসে উঠল একটি অসম্ভব বর্ণনায়:

‘বিকেল মুছে নামতে শুরু করেছে গোধূলি
বাঁশবাগানে চাঁদ উঠেছে ঠিক যেন এক মড়ার মাথার খুলি।'

ছোটদের জন্য লেখাতেও সৌন্দর্যের চেনা ধারণা কত অবিকলভাবে তছনছ করে দিলেন লেখক। একটু পরেই এই কথা পুনরুক্ত হয়েও নতুনতর হয়ে উঠেছে মারাত্মক মিলের দাক্ষিণ্যে:

“খিদেয় যারা কাঁদছিল, আর ভয়ে কাঁদছে না।
মড়ার খুলির মতন চাঁদ ছড়াচ্ছে জ্যোৎস্না।'

মিল ও অনুপ্রাসের খেলায় অমরেন্দ্র চক্রবর্তী যে-দাপট দেখিয়েছেন, একমাত্র সুকুমার রায় ছাড়া বাংলা কবিতায় তার কোনও জুড়ি নেই। বলার কথা হল, শুধু মিলের জন্যই মিল দেবার একমাত্রিক কৌশলে বিশ্বাস ছিল না তাঁর। গোপনতম হলেও একটা অর্থময় যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতেন তিনি। শশ্মানঘাটে শম্পানি খায় শশব্যস্ত শশধর' জাতীয় কালোয়াতি খুব বেশি পাওয়া যাবে না তাঁর লেখায়।
মিলের বিচিত্র সব আয়োজন বইটির লাইনে লাইনে। বোঝাতে হলে পুরো বইটিই প্রায় উদ্ধার করতে হয়। আরও দুয়েকটি তুলছি:

হয়তো কোনো গোপন পরামর্শ।
ভঙ্গি যেন শিকার দেখে চিতার আর না তর সয়।

‘মনে রাখিস সবাই তোরা গয়লা
জয় মা কালী! আমরা করব জয়লাভ!'

‘রাত দুপুরে কেষ্টলীলা! কই সে কেষ্ট নেই?
চোখ ঘুরিয়ে দেখল হীরু তাদের ঘিরে পুলি বেষ্টনী।'

‘তখন বললে চাঁদের হাট, চাঁদের হাটটা কী?
নিছক ওটা কথার কথা? নেহাত ঠাট্টা কি?

কথার কথাই বলেছেন হীরু ডাকাত-এর কথক। কিন্তু ঠাট্টা না হয়ে থেকে তা আমাদের গল্প শোনার চিরকালীন মনের কাছে আনন্দময় বিস্ময়ের স্পর্শ হয়ে আছে।


লেখক পরিচিতি
কবি, প্রাবন্ধিক, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান।