কুরচি দাশগুপ্ত

আশির দশকের কলকাতায় ‘হীরু ডাকাত’-এর নাম না শুনে বা না পড়ে কে বেড়ে উঠেছে! পরবর্তী কালে লেখকের বেশ কিছু কাজ ইংরেজিতে তরজমা করতে পেরে নিজে সম্মানিত বোধ করেছি। এই সম্মান এসেছিল ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্র ধরে: আমি ছিলাম তাঁর ছোট মেয়ে মৈত্রেয়ীর বন্ধু। সেইসঙ্গে সেসময় আমি ও মৈত্রেয়ী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের ছাত্রী, যেখানে বহু বছর আগে অমরেন্দ্র চক্রবর্তী নিজেও ছাত্র ছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি-কমিটিকে পালটা প্রশ্ন করে ততদিনে সেখানকার কিংবদন্তী। সে প্রশ্ন ছিল: ‘আমি আপনাদের কাছে থেকে কী শিখব বলে আশা করছি, আপনাদের এ প্রশ্নের বদলে, আপনাদের কাছে আমার জিজ্ঞাস্য, আপনারা আমায় কী শেখাবেন বলে আশা করেন যা থেকেআমি লাভবান হব?’ মাঝপথে তাঁর পড়াশোনায় ইতি টানা এবং ‘কবিতা-পরিচয়’- কী ভাবে আধুনিক কবিতা পাঠ করতে হবে সেই সংক্রান্ত মাসিক পত্রিকা প্রকাশ সে সময়ের ঐতিহাসিক ঘটনা।

‘ছেঁড়া কাঁথার গল্প’ ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় ২০০৯-এ, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট থেকে। তার প্রায় দশ বছর পর আমার ‘বিষাদগাথা’ অনুবাদের সৌভাগ্য হয়, যেটি সামনেই কখনও হয়তো প্রকাশিত হবে। ২০০৭-এ তিনি আমার শিল্পচেষ্টাকেও স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন ‘নেকড়ের চোখ’ বইয়ের অলংকরণ করতে দিয়ে। এটি ছিল দানিয়েল পেনাকের ‘ল্যয়ি দ্যু লু’ কিশোর উপন্যাসের মৈত্রেয়ীর করা অনুবাদ। ২০১১ সালে তিনি নিজে যখন পেইন্টিং করা শুরু করে আমার মতামত জানতে চাইলেন, তখন যেন সেই বৃত্তটা সম্পূর্ণ হল।

অমরেন্দ্র কাকুর আশি বছরের জন্মদিন উদযাপনের মুহূর্তে তাঁর শিল্পচর্চার কয়েকটি দিক উপস্থাপন করতে চাই। প্রথম দর্শনে তাঁর পেইন্টিংকে একজন লেখকের অলংকরণের প্রয়াস হিসেবে খারিজ করে দেওয়া সহজ। কিন্তু এর চেয়ে বড় সত্যের অপলাপ আর নেই। তাঁর কাজ অলংকরণের অনেক ঊর্ধ্বে। সেগুলি এক আত্মমগ্ন জগতের ছবি যার অন্তর্লীন বাস্তবতা আমাদের প্রতিদিনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র এবং বর্ণনার মধ্যে যে-অকপট সারল্যের সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়েছি, তাঁর শিল্পচর্চায় প্রবল বিস্ফারে সেসবই দৃশ্যগত ভাবে প্রস্ফুটিত।

তাঁর পেইন্টিংয়ে একাধিক স্পেস একটির ওপর আরেকটি জমা হচ্ছে, দূরত্ব মুছে অনেকটা শিশুমনের মতো। কিন্তু এ কাজ কোনও কাঁচা হাতের নয়। তাঁর কাজে বরাবর অন্তর্লীন থাকে বিশেষ ভাবে পরিশীলিত একটা কাঠামো। রং প্রায়শই উজ্জ্বল, কখনও ইচ্ছাকৃত ভাবে অনচ্ছ। প্রায় সব ক্ষেত্রে এ দু’য়ের পাশাপাশি অবস্থান অপ্রত্যাশিত, অচেনা। ভাষাগত এবং বাস্তবতার দিক থেকে ব্যাখ্যাতীত হলেও তাঁর শিল্পকর্মের প্রতি আমাদের টানে চেনা-অচেনার মধ্যে এই দোলাচল। আমাদের সামনে এনে দেয় বর্ণনাত্মক কাঠামোয় বাঁধা পড়া সময়ের কিছু হিমায়িত মুহূর্ত যাকে
দৈনন্দিনের বাস্তবতা ছুঁতে না পারলেও আশ্চর্যজনক ভাবে পরিচিত মনে হয়। স্বপ্নে, দুঃস্বপ্নে প্রায়শই সেই মুহূর্তগুলির মুখোমুখি হই, কিন্তু বাস্তবে তার কোনও চিহ্ন কোথাও প্রায় দেখিই না।

তাঁর শিল্পকর্মকে ‘আর্ট ব্রুট’ গোত্রায়িত করাটা সহজ, যেহেতু তা সমকালীন প্রচলিত শৈল্পিক ধারাকে খারিজ করে, নির্দিষ্ট ছকে পড়া থেকে পালাতে চায় এবং বাজারের প্রবণতাকেও গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু তাঁর ছবির স্থানিক অন্বেষণ, রঙের ব্যবহার এবং বিষয়বস্তু বরং আমাদের ইউরোপীয় আধুনিক শিল্পকলার সূচনাবিন্দুতে নিয়ে যায়, বিশেষ করে জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের দিকে— হয়তো ডে ব্লো রাইটারের দিকে যা আমাদের খুব সহজেই ক্যান্ডিনস্কি এবং ক্লি-র সমীপবর্তী করবে, পরে ইউরোপে একাধিক শিল্প আন্দোলনে যাঁদের ভূমিকা ছিল। সেই আন্দোলন যা সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ এবং উত্তরাধিকারের মাধ্যমে আমাদের নিজস্ব আধুনিকতাকে ব্যাখ্যা করে। তাঁর কাজে এমন এক সারল্য আছে যা আধ্যাত্মিকতা এবং লোকশিল্পকে উদ্যাপন করেও তাঁর পারিপার্শ্বিক এবং অনুভূতির যাদু-সংযোগে বাস্তবের মাটিতে প্রোথিত। তাঁর ছবি দেখে পরবর্তী সময়ে ভাবতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, তাঁর পেইন্টিং সবচেয়ে বেশি মনে পড়ায় হুয়ান মিরো-র কাজ। নিজস্ব জমিতে দৃঢ় প্রোথিত শিকড়ের মধ্য দিয়ে যখন আত্মার নিঃসঙ্গতা এবং আলোর অন্বেষণ করা হয়, তখন কখনও কখনও তা বিশ্বজনীন হয়ে ওঠে।

তাঁর পরবর্তী কালের লেখা ‘বিষাদগাথা’য় যাদু-বাস্তবতার উপাদান প্রবল ভাবে দেখা গিয়েছে। ২০১২-য় সাময়িক পত্রে ধারাবাহিক আকারে উপন্যাসটি কিস্তিবন্দি হয়। প্রায় একই সময়ে তিনি পেইন্টিং করতেও শুরু করেন, এটা কাকতালীয় ঘটনা নয়। সারা জীবন পৃথিবী জুড়ে এবং মানবমনের অন্তঃপুরে ভ্রমণ তাঁকে ঈর্ষণীয় দক্ষতার এক শিল্পী করে তুলেছে। এবং কল্পনাশক্তির কথাও অবশ্যই বলতে হবে। তিনি যেন পার্থিব বাস্তবতার সীমা লঙ্ঘন করে পাড়ি দিলেন অসীমে আর আমাদের সাদামাটা অস্তিত্ব পেয়ে গেল অপার্থিবের হাতছানি।

লেখক পরিচিতি

চিত্রশিল্পী, আন্তর্জাতিক শিল্প সমালোচক, শিক্ষক


চিত্রকলা বিভাগে ফিরে যান