লুসিফার লায়লা

আঁকিয়ে চরিত্রটি আমাদের প্রাচীনতম । জীবনে কখনও ছবি আঁকেননি এমন মানুষ পাওয়া অসম্ভব নয়, দুষ্কর। বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অবস্থা এবং অবস্থানগত বাস্তবতায় আঁকিয়ে সত্তাটি বেশির ভাগের মিলিয়ে যায়। কারও কারও সে চরিত্রটি ঘুমিয়ে থাকে জেগে ওঠার বিপুল সম্ভাবনায়। শৌখিন চিত্রকরদের বিশেষ কারও ক্ষেত্রে এই ঘুম ভাঙা চিত্রকর সত্তাটি ফেরে দারুণ সম্ভাবনা নিয়ে । রবীন্দ্রনাথ তার অন্যতম উদাহরণ,শুরু করেছিলেন সত্তর বছর বয়সে! সত্তরে শুরু করে বিরামহীন এঁকেছেন, বলা বাহুল্য সেইসব চিত্রকলা আমাদের আধুনিক চিত্রকলার দিক নিদর্শন দিয়েছে কেবল তা নয়, এগুলো আমাদের শিল্পের অসামান্য সম্পদ। শিল্পী অমরেন্দ্র চক্রবর্তীও ছবি আঁকা শুরু করেছেন সত্তর বছর বয়সে। রবীন্দ্রনাথের বয়সটাই তিনি বেছে নিয়েছেন ছবি আঁকার জন্যে তা নয়। এই বয়সে দাঁড়িয়ে তাঁর ছবি আকার মন সপ্রতিভ হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মিলে যাওয়াটা কাকতলীয়। দীর্ঘ দিনের নানান অভিজ্ঞতার পলি জমে তাঁর ভেতরটা যেভাবে তৈরি হয়েছে তারই ছাপ পড়েছে তাঁর আঁকা ছবিতে।

কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সম্পাদক, পরিব্রাজক এমন অজস্র চরিত্রে তাঁকে আমরা পেয়েছি, সত্তরে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর চিত্রকর সত্তাটিকে নিয়ে নতুন রূপে এলেন। রং তুলিতে তিনি তাঁর মনোভাবের নতুন ভাষা তৈরি করেছেন। ছবি আঁকার কোনওরকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই অথচ ছবিতে নানা অবয়ব ফুটিয়ে তুলে পুরনো থেকে সমসাময়িক বাস্তবতা সব কিছুরই চমৎকার অভিনিবেশ ঘটিয়েছেন। ‘আকারের স্মৃতি, জগতের অভিজ্ঞতা আর মনের ব্যথা মিলিয়ে আঁকি’ নিজের ছবি আঁকার প্রসঙ্গে এমনটাই বলেন তিনি। তাঁর এমনও মনে হয়, তাঁরই কথায়, ‘পথের ধুলোয় পাথরে, সমুদ্রসৈকতে ঝিনুকে শঙ্খে প্রবালে মানুষের বহু যুগের ফেলে যাওয়া লৌকিক-অলৌকিক অসংখ্য গল্প পড়ে থাকে। সুদূর অতীত, অত্যুজ্জ্বল বর্তমান ও ঝাপসা নীল ভবিষ্যতের গল্প সেসব।' দেশ-দেশান্তর ঘুরতে ঘুরতে তিনি এসবই দেখেন, শোনেন। তাঁর ছবিতে তাই বোধহয় কখনও কখনও গল্পের ঝাপসা অবয়ব ফোটে। শিল্প সংস্কৃতি আদতে যে মনেরই চাপা পড়া আখ্যানের ফসিল, গভীর ব্যথা বোধেরই নান্দনিক অনুরণন, তাঁর ছবি দেখে সে কথাই মনে হল আবার। বাস্তব আর অবাস্তবের মিশেল দিয়ে রহস্যময় মনোজগৎকে তিনি ধরতে চেয়েছেন ছবিতে, এমনটাই তিনি মনে করেন। প্রথম যখন তাঁর ছবি দেখি তখন একটু থমকে গিয়েছিলাম, কেননা এ কথা মনে হয়নি তিনি শৌখিন চিত্রকর! ছবির বিষয়-ভাবনা, রঙের ব্যবহার, উপস্থাপন শৈলী এবং পরিমিতি বোধ মিলিয়ে তাঁকে আর শৌখিন চিত্রকর ভাবতে দেয়নি। শিল্প সমালোচকের পর্যবেক্ষণ আমার নেই, আমার কেবল দেখার অপরিসীম আগ্রহ। সেই আগ্রহ থেকেই তাঁর আঁকা ছবি দর্শক হিসেবে যে ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে আমার মধ্যে, তারই খানিকটা এইখানে লিখে রাখা।

তাঁর ছবি তাঁর মনোভাবেরই সাবলীল অনুবাদ। পৌরাণিক গল্প থেকে উঠে আসা চরিত্রকে আশ্রয় করে স্বপ্ন অথবা আকাঙ্ক্ষাকে ধরছেন কোনও ছবিতে। কোনও কোনও ছবির সামনে দাঁড়িয়ে পিকাসোর শৈলী মনে এলেও বিষয়-ভাবনা এবং উপস্থাপনের ভিন্নতা অন্য মাত্রা যুক্ত করেছে। বিষয় হিসেবে বার বার এসেছে ঘুড়ি, পাখি, ঘোড়া এবং মানুষ। একটা হাত কাটা বালক তার কাটা হাতেই ঘুড়ি উড়িয়ে চলেছে, এ যেন অদম্য ইচ্ছেশক্তির বার্তা দেওয়া প্রাচীনতম গল্পের বাহক। ভ্রমণ তার সবচেয়ে প্রিয় নেশা। পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ছুটে বেড়ান বয়সের ভারকে উপেক্ষা করে। ছবিতে বার বার ঘোড়া ফিরে আসা দেখে তার চেনা দর্শকদের মনে পড়তেই পারে তার ভ্রামণিক চরিত্র। ‘শাদা ঘোড়া’ নামের দারুণ শিশু সাহিত্যের রচয়িতার মুখও মনে আসতেই পারে। ছুটে চলার প্রাণবন্ত মন তাঁকে ঘোড়ার মতো গতিশীল প্রাণীর দিকেই আগ্রহী করে তুলবে এমন ভাবনা অমূলক নয়। ওঁর সাদা ঘোড়ার ছবি দেখার সময় বিখ্যাত ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টার এবং ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পধারার রূপকারদের মধ্যে অন্যতম ইউরোপিয়ান চিত্রকর টার্নারের কথা মনে হয়েছে। জীবনের শেষদিকে এসে টার্নার ছুটে চলা সাদা ঘোড়ার ছবি এঁকেছেন বার বার। সে ঘোড়া তার কাছে মৃত্যু দূতের প্রতীক। অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর ঘোড়া গতিময়তার সমার্থক। সমসাময়িক সামাজিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা ব্যক্তি মানুষের ভাবনার জগতে যে তোলপাড় ঘটায় সেসব কিছুও বিষয়বস্তু হিসেবে তাঁর ছবিতে মূর্ত হয়েছে।

ক্যানভাসে রং চাপিয়ে চলেন স্বাধীন ইচ্ছেতে, সেই রঙের ছাপের মধ্যে শিশুর মন নিয়ে খুঁজতে থাকেন নানান আকার। কখনও সে ছাপের ভেতর ঘোড়ার ভঙ্গি দেখছেন কখনও বা দেখছেন মানুষ অথবা পাখির অবয়ব। তুলির সামান্য টানে মনের দেখাটিকে বাস্তবে রূপ দিয়ে মূর্ত করে তুলেছেন। মনের বিচিত্র গতি আর বাস্তবতার সঙ্গে সাজুয্য রেখে আঁকা তার ছবিগুলোর ভেতর ইম্প্রেশনিস্টদের প্রকাশভঙ্গিও খুঁজে নেওয়া চলে। এঁকেছেন চমৎকার কিছু ল্যান্ডস্কেপও। পাহাড়ঘেঁষা নদী, তার সঙ্গে সমতলের জীবনের আভাস, আবার নগর জীবনের ক্রমশ সবুজ শূন্য হয়ে আসা পাথুরে সভ্যতাও তিনি চিত্রিত করেছেন। ল্যান্ডস্কেপগুলোতে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার মাতিসের কালার প্লেটকে মনে পড়িয়ে দেয়। কেবল ক্যানভাস আর রঙের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, তার ড্রয়িংগুলোও আলাদা করে দৃষ্টি কাড়ে। ‘ক্ষণের বচন’ নামের দুই পংক্তি, চার পংক্তির পদগুলির অলংকরণে সরু সরলরেখায় আঁকা অবয়বের সঙ্গে মোটা লাইনে আঁকা রেখাচিত্রগুলোও যেন দু’চার শব্দে লেখা ছোটগল্প।

নিয়মিত লিখছেন, সম্পাদনা করছেন, নতুন নতুন ভ্রমণের পরিকল্পনা করছেন আর মন খুলে রঙের প্রলেপ দিয়ে চলেছেন ক্যানভাসে। শরীরি কাঠামোতে বয়সের দাগ কাটাকে উড়িয়ে দিয়ে জীবন উপভোগের মন্ত্রণা দেওয়া তরুণ চিত্রকর অমরেন্দ্র চক্রবর্তী। তাঁর ছবির প্রশংসায় শিল্প সমালোচকেরা লিখেছেন নানা জায়গায়। শৌখিন আঁকিয়ে’ কেবল এই তকমায় তাঁকে বাঁধা চলে না, বরং একথা বলাই যায় তাঁর ছবি শিল্পরসিকের মনের খোরাক আর আমাদের শিল্পের সম্পদ।

লেখক পরিচিতি

চিত্রশিল্পী, লেখক আর মূলত পাঠক এবং শ্রোতা। থাকেন অস্ট্রেলিয়ার এডিলেডে।

চিত্রকলা বিভাগে ফিরে যান