মৃণাল ঘোষ

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী তাঁর ছবি নিয়ে দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী করলেন সম্প্রতি আইসিসিআর-এর অবনীন্দ্র গ্যালারিতে। শ্রীচক্রবর্তী সংস্কৃতির জগতে একজন সুপরিচিত মানুষ। একাধারে তিনি কবি, কথা-সাহিত্যিক এবং সম্পাদক। শিশু সাহিত্যিক হিসেবেও তিনি প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘কালের কষ্টিপাথর’, ‘ছেলেবেলা’, ‘কর্মক্ষেত্র’, ‘ভ্রমণ’ ইত্যাদি পত্রিকা। ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সাতটি কবিতার বই, ২১টি কথা-সাহিত্য বিষয়ক বই, যার মধ্যে ১৩টি ছোটদের জন্য। ভ্রমণেও তিনি উৎসাহী। মধ্য আফ্রিকার গভীর বনাঞ্চল রোয়ান্ডা ও উগান্ডায় ভ্রমণ করে বন্য প্রাণীর ছবি তুলেছেন। তা সত্ত্বেও একটি বিশেষ প্রকাশনার জন্য তিনি স্মরণীয়। ষাটের দশকে তিনি সম্পাদনা করেছেন ‘কবিতা-পরিচয়’ পত্রিকা। সেখানে বিখ্যাত এক একটি কবিতা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করতেন খ্যাতনামা কবি ও লেখকরা। কবিতা চর্চার ক্ষেত্রে এই পত্রিকা গভীর অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল।

এরকম বহুগুণান্বিত একজন মানুষ পরিণত বয়সে পৌঁছে ছবি আঁকার দিকে মনোনিবেশ করেছেন। শিল্পকলার ক্ষেত্রে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর নেই। হয়তো অনেক দিন থেকেই তিনি ছবি আঁকেন। কিন্তু প্রদর্শনীর মাধ্যমে সেই ছবি জনসমক্ষে নিয়ে আসছেন অল্প কিছুদিন থেকে। তাঁর ছবির রূপাবয়ব বা ফর্ম-এর ভিত্তি হচ্ছে আদিমতা। প্রিমিটিভিজমকে দু'ভাবে আত্মস্থ করেছে আধুনিকতাবাদী চিত্রকলা। এক্সপ্রেশনিজম ও কিউবিজম এই দুই আঙ্গিকে বাস্তবকে যে কল্পরূপে রূপান্তরিত করা হয় তার প্রধান একটি ভিত্তি হচ্ছে আদিম মানুষের প্রকাশভঙ্গি। অমরেন্দ্র এই দুটি রূপরীতি স্বতন্ত্রভাবে ব্যবহার করে গড়ে তোলেন তাঁর ছবি।

আধুনিকতাবাদী চিত্রকলায় আদিমতা আত্তিকরণের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে এ প্রসঙ্গে। ইউরোপে পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট চিত্রধারায় স্বাভাবিকতা ভেঙে কল্পরূপাত্মক অন্তর্মুখীনতার উৎসারণ ঘটতে থাকে। ভ্যানগঘ ও গঁগা-র ছবিতে এই আবেগদীপ্ত অন্তর্মুখীনতার প্রকাশ গভীরভাবে প্রভাবিত করে সমকালীন ও পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের। সেজানে-র ছবিতে এল ত্রিমাত্রিক সংহতি ও গাঠনিকতা নিয়ে গবেষণা। এরই পরবর্তী বিকাশে ১৯০৫ সালে জার্মানিতে জেগে উঠল এক্সপ্রেশনিস্ট আন্দোলন। এডওয়ার্ড মুঙ্খ যার পূর্বসূরি। ১৯০৭ সালে প্যারিসে আলোড়ন তুলল কিউবিজম। যার প্রধান প্রবক্তা পিকাসো এবং ব্রাক। এই দু'টি আঙ্গিকই আদিমতার উৎস থেকে রসদ সংগ্রহ করল। বিংশ শতকের প্রথমার্ধে মানুষের যে আত্মিক সংকট তার প্রকাশে আদিমতার অবদান অসামান্য।

আমাদের দেশে আদিমতার উৎস থেকে রসদ সংগ্রহ করেছেন সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছবিতে। রবীন্দ্রনাথ এক্সপ্রেশনিজমকে যতটা আত্মস্থ করেছেন, কিউবিজম ততটা নয়। ১৯৪০-এর দশকের অনেক শিল্পী এই দুটি আঙ্গিককে ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে আত্মস্থ করেছেন। এদিক থেকে রামকিঙ্করের অবদান উল্লেখযোগ্য। এফ এন সুজা, পরিতোষ সেন প্রমুখ শিল্পীও এই দুই আঙ্গিককে নানাভাবে ব্যবহার করেছেন। ১৯৬০-এর দশকের রবীন মণ্ডলও অনস্বীকার্য।

অমরেন্দ্র চক্রবর্তীকে বলা যেতে পারে এই ধারারই একজন উত্তর-সাধক। এই যে হিংসা, সন্ত্রাস বিপর্যস্ত করছে বিশ্বকে, যাতে বিধ্বস্ত হচ্ছে প্রকৃতি, শিশুরাও নিস্তার পাচ্ছে না এই বিনষ্টির গ্রাস থেকে— তাকেই নানাভাবে ছবিতে ধরতে চেষ্টা করেছেন শিল্পী। কোথাও অবশ্য সৌন্দর্যকেও বিশ্লিষ্ট করেছেন কিউবিস্ট গাঠনিকতায়। একটি নীলিমা ব্যাপ্ত নিসর্গের ছবি আছে যেখানে শিল্পী পাহাড় ও জলাশয়ের রূপারোপ করেছেন। পাহাড়কে তিনি জ্যামিতিক গাঠনিক কৌণিকতায় বিশ্লেষণ করেছেন, তাতে একই সঙ্গে সেজান ও পিকাসোর উত্তরাধিকার অনুভব করা যায়। একটি ফুলের ছবি আছে, চন্দ্রমল্লিকা জাতীয়। সমস্ত অনুষঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফুলটিকে যেভাবে তুলে ধরেছেন শিল্পী তাতে পরিব্যাপ্ত শূন্যতায় সৌন্দর্যের আকুতি ধরা পড়ে। এভাবে মগ্ন অনুভবে প্রকৃতি ও জীবনের নানা সংকটকে চিত্রায়িত করেছেন তিনি।

সৌজন্য: আনন্দবাজার পত্রিকা। প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি, ২০১৬

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৪৪। শিল্পকলা বিষয়ে গবেষক ও লেখক। এ-বিষয়ে এপর্যন্ত তাঁর ছাব্বিশটি বই প্রকাশিত হয়েছে। আরও চারটি বই প্রকাশের অপেক্ষায়। আনন্দবাজার পত্রিকায় নিয়মিত শিল্প-আলোচনা লিখেছেন। ১৯৮৯ থেকে ২০১৬, সাতাশ বছর। এছাড়া এপর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তাঁর এগারোটি কবিতার বই।


চিত্রকলা বিভাগে ফিরে যান