আধুনিক বাংলা কবিতার আলোচনা
প্রতিষ্ঠাকালঃ ১৯৬৬
মাসিক পত্রিকা
সম্পাদকের কথা
সংকলন-সংখ্যার বিচারে না হলেও সময়ের হিসেবে কবিতা-পরিচয়ের এক বছর পূর্ণ হল। আমাদের মনে প্রধান তাগিদ ছিল রবীন্দ্রনাথ থেকে সাম্প্রতিককালে প্রসারিত, অভিজ্ঞতায় দুরূহ ও রূপে জটিল নতুন বাংলা কবিতার যতদূর-সম্ভব-সম্পূর্ণ পরিচয় গ্রহণে। প্রসঙ্গটি নিয়ে পত্রিকার প্রথম সংখ্যার জন্য আমি একটি দুর্বল ভূমিকা লিখেছিলাম, কিন্তু প্রকাশের পূর্বে অন্যান্য রচনার প্রুফের সঙ্গে লেখাটি হারিয়ে যায়, তার আর কোনো কপি ছিল না, নতুন করে লেখারও আর চেষ্টা করা হয় নি। এখন, কবিতা-পরিচয়ের এই প্রথম পর্যায়ের সমাপ্তিতে নতুন করেই সেই ভূমিকার প্রয়োজন বোধ করছি, এবং ইতিমধ্যে নতুন কিছু প্রসঙ্গেরও হয়তো প্রয়োজন হয়েছে।
যেহেতু কবিতা কেবল তার গদ্যার্থ নয়, বা কবির বক্তব্য প্রকাশক নিবন্ধমাত্র না, নিছক ছন্দ-মিলের অহেতুক কারুকর্মও না, ভাষায় রচিত শিল্পবিশেষ, এক অনিবার্য রূপসৃষ্টি, যেহেতু এই রূপের মধ্যে ধরা আছে কবিতা, এবং রূপের সমগ্রতাই কবিতা, সেইজন্যই কবিতা-আলোচনায় আমাদের মৌল মনোযোগ ছিল কাব্যরূপে, তার শব্দ-সন্ধান ও সংস্থাপনে, এমনকি শব্দের সকল সম্ভাব্য অনুষঙ্গ ও সাংগীতিক নির্দেশও লক্ষ করবার চেষ্টা করেছি। কবিতার গদ্যার্থ ভুলি নি, কবির মনোভঙ্গি মনোযোগের জটিল বিষয় মেনেছি, যাকে বলা যায় sociology of poetry তাতেও আমাদের আগ্রহ সজাগ ছিল; কিন্তু বিশেষ করে বলবার কথা এই ছিল যে, কবিতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে, অন্তঃস্থ কল্পনা-শৃঙ্খলার এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশের এবং সব অংশের সঙ্গে সমগ্রের সম্পর্ক ও সামজ্ঞস্য সন্ধানে এই সবই, কবিতার সমস্তই আরো বেশি স্বচ্ছ হওয়া সম্ভব।
কবিতা-পরিচয়ের এই পদ্ধতি বিষয়ে অনেক সংশয়ের কথা শুনেছি। সংশয়ীদের বক্তব্য খুবই ভদ্র, সে-হিসেবে তা স্বাস্থ্যের লক্ষণ। এখানে তা নিয়ে তর্ক বিস্তারের সুযোগ নেই, কেননা ক্রমশ সেইসব তর্কের মীমাংসা করাই কবিতা-পরিচয়ের কাজ। এখানে কেবল একটা প্রশ্ন তোলা যায় : কবিতা পরিচয় কি কোনো পদ্ধতিমাত্র? এই এক বছরের প্রয়াসের মধ্যে আমরা কি পূর্ব বা পশ্চিমের কোনো নির্জীব রীতির দাসত্ব করেছি ? সে-কথা কারো মনে হয়ে থাকলে, খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই : নতুন কবিতাই আমাদের সমালোচনার প্রধান শিক্ষাস্থল ; তারসঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কবি-সমালোচকের কাব্যচর্চার নিজস্ব অভিজ্ঞতা।আলোচনার আয়তনে কাব্যের সমগ্র পরিচয় ধারণের তাড়নাই সমালোচককে তার রীতি তৈরি করে দেয়, এ-কথায় পণ্ডিতি সমর্থননা মিলতে পারে কিন্তু এর সত্যতা কাব্যের অভিজ্ঞতায় মানতে হয়।কবিমাত্রেই তো নতুন ঔচিত্যের স্রষ্টা, সহৃদয় সামাজিককেও তাই নতুন নতুন চাবি নিয়ে ভিতরে ঢুকতে হবে, এই সহজ সিদ্ধান্তে আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষেরাই পৌঁছে গিয়েছিলেন- আজ আবার তার ক্লান্ত
পুনরুল্লেখের প্রয়োজন কেন ? এবং এই অর্থেই কবিতা-পরিচয়ের বিভিন্ন লেখায় পদ্ধতির অমিল অসংগত নয়; পদ্ধতিই কি শেষ কথা?
কিন্তু একটা সামান্য সূত্র তবু রয়েছে। কবিমনের বিচিত্র বিসর্পণ, কূটস্থ দার্শনিকতা, সময়- ও সমাজ-চেতনা, ভূমার বোধ অথবা নিরর্থ নাস্তি, বৈদেহিকতা কিংবা ইন্দ্রিয়-লালসা – এইসব এবং আরো অনেক কিছু, কবিতার বা কবিতা-আলোচনার বিষয় হতে পারে; কিন্তু গোটা কবিতা তার উপকরণের অতিরিক্ত একটা অখণ্ড শক্তি। সেই শক্তির স্বরূপ কী-কবিতা-পরিচয়ের পাঠককে তার উত্তরের দিকে অনেকটা এগিয়ে দিতে পেরেছি বলেই মনে হয়।
কিন্তু এই স্বল্প আয়তনে বাংলা কবিতার স্বভাব-চরিত্র হয়তো আংশিকভাবেও ধরা সম্ভব হয় নি।যাঁদের কবিতা আলোচনা করা হয়েছে, তাঁদের যোগ্য কবিতাগুলি সব সময়ে আমরা নির্বাচন করতে পেরেছি তা-ও নয়। তার চেয়ে পরিতাপের বিষয়, আলোচনার যোগ্য অনেক কবির কোনো রচনাই আজও আমরা গ্রহণ করতে পারি নি। তার কারণ অমনোযোগ নয়, পত্রিকার ক্ষীণ আয়তন ও অনিয়মিত প্রকাশ এবং সর্বোপরি প্রকাশযোগ্য আলোচনার অভাব; কেবল এই কারণেও অনেক নির্বাচিত কবিতা শেষ পর্যন্ত বাদ দিতে হয়েছে। প্রকাশিত সব আলোচনাও যে সর্বদা আলোচিত কবিতার স্বরূপ নিঃশেষে প্রকাশ করেছে, এমনও হয়তো নয়। এই সব অতৃপ্তি এবং অপূর্ণতার কথা আমাদের মনে আছে। কিন্তু তবু বোধহয় বলা চলে, নতুন স্তর থেকে বাংলা কবিতার দিকে ফিরে তাকানোর প্রয়াস, অন্তত তার প্রয়োজনের প্রমাণ, কবিতা-পরিচয়ের রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে।
আমাদের এই ক্ষীণ কর্মে নানা সমস্যা পীড়িত স্বদেশে যে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া ও সহযোগিতা পেয়েছি, তার তুলনা মেলা সহজ নয়, তাকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। তাতে যে কেবল আমরা উৎসাহিত হয়েছি তা-ই নয়, বাঙালীর অসাধারণ কাব্যপ্রীতির পরিচয়ে এই সহযোগিতা শ্রদ্ধেয়। আমরা মানি যে, মননশীল পাঠকের পরিগ্রহণেই পত্রিকার সার্থকতা, অন্য কিছুতে নয়।
২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৪